শুক্রবার ১৫ আগস্ট ২০২৫ - ১২:২৬
কেন নেতা ও কর্মকর্তাদের জন্য দান ও সদয়তা অপরিহার্য?

মানবজীবনে নৈতিক ও আত্মিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দান ও সদয়তা। ইসলামী সমাজব্যবস্থায় দায়িত্বশীল ব্যক্তি শুধুমাত্র ক্ষমতা ও পদে নেই, বরং তার আভ্যন্তরীণ নৈতিক ও আত্মিক দায়িত্বও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: কৃপণতা একটি নৈতিক রোগ, যা ধর্মবিশ্বাস, নৈতিকতা ও জীবনধারায় গভীর প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং পরিবার, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান এবং পুরো সমাজে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। কৃপণতা মানুষের মধ্যে নানারকম রোষ, কষ্ট ও নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে এবং এটি নানারকম অনৈতিক আচরণের চেইন তৈরি করে।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রভাব
ব্যক্তিগত জীবনে, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই কৃপণতা বিপদসঙ্কেত হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারে, বিশেষ করে কৃপণ পিতামাতা, তাদের আচরণের মাধ্যমে সন্তানদের সুনাম, মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেন। অনেক সময়, পরিবারের কৃপণতা শিশু ও কিশোরদের মানসিক শান্তি ও সৃজনশীলতার উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সামাজিক ও সাংগঠনিক প্রভাব
সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেও কৃপণতা কাঠামোগত দূষণ ও অবক্ষয়ের কারণ হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো প্রতিষ্ঠানে গবেষক বা দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো বই প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট গবেষক বা লেখকের নাম বা স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এটি কেবল নৈতিকতার বিপরীত নয়, বরং সহকর্মীর মর্যাদার প্রতি কৃপণতার প্রকাশ, যা আহলে বাইতের শিক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিরোধপূর্ণ।

দান ও খিলাফতের শিক্ষা
আল্লাহতায়ালা আভ্যন্তরীণ খিলাফতের (ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও আত্মিক নেতৃত্ব) কাঠামোতে “দান”-কে ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করেছেন। বাহ্যিক দায়িত্বও—যেমন শাসক, কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপক—প্রদত্ত সম্পদকে সদয় ও দানশীলভাবে পরিচালনা করতে হবে। যে ব্যক্তি এই নীতি মানতে অস্বীকৃতি জানায়, তাকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়, কারণ সে কেবল ব্যক্তিগত কৃপণতা নয়, “সংগঠনিক কৃপণতা” সৃষ্টি করে, যা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

সূরা হাদীদ (৫৭:৭)-এ আল্লাহ বলেন:

آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَنْفِقُوا مِمَّا جَعَلَکُمْ مُسْتَخْلَفِینَ فِیهِ

“আপনরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দিয়েছে, যার মধ্যে তোমাদেরকে খিলাফত প্রদান করা হয়েছে, তা দান কর।”

সূরা মুহাম্মদ (৪৭:৩৮)-এ আল্লাহ বলেন:

هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوا فِی سَبِیلِ اللَّهِ فَمِنْکُمْ مَنْ یَبْخَلُ وَمَنْ یَبْخَلْ فَإِنَّمَا یَبْخَلُ عَنْ نَفْسِهِ وَاللَّهُ الْغَنِیُّ وَأَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ...

“দেখো, তোমাদেরকে আহবান করা হচ্ছে আল্লাহর পথে দান করার জন্য। তোমাদের মধ্যে কেউ কৃপণতা প্রদর্শন করে। যে কৃপণতা প্রদর্শন করে, তা মূলত নিজের ক্ষতি। আল্লাহ তো অমর্যাদাকর, আর তোমরা দরিদ্র।

কৃপণতা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব
আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেছেন,

انظر إلی البخیل، یقسُ القلب

“কৃপণ ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি হৃদয়কে কঠিন করে দেয়।”

[নসিহত, নাহাজুল বালাগা]

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন,

عَجِبْتُ لِمَنْ یَبْخَلُ وَالدُّنْیَا مُقْبِلَةٌ عَلَیْهِ

“আমি বিস্মিত হচ্ছি যে, এমন ব্যক্তি যারা বিশ্বের সম্পদ ভোগ করছে অথচ দান করতে কৃপণ।”

বাস্তব জীবনের উদাহরণ
একটি প্রশাসনিক দপ্তরে দেখা যায়, কর্মকর্তা তার অধীস্তদের শ্রমের পুরো স্বীকৃতি নিজের নামে লিখে নেন বা তাদের অবদানকে অস্বীকৃত রাখেন। এটি কেবল কৃপণতার প্রকাশ নয়, বরং সহকর্মীর নৈতিক অধিকার ও মর্যাদার প্রতি অবহেলার প্রতিফলন। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য, দান ও স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে নেতৃত্ব সমাজে নৈতিক ও মানসিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।

দায়িত্বশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ
অতএব, যারা দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের জন্য জরুরি যে তারা জনগণ ও অধীস্তদের প্রতি সদয় ও দানশীল হোক, যাতে তারা মানসিক শান্তি অনুভব করে এবং আল্লাহর পথে আত্মসংযম, আত্মসংশোধন ও নৈতিক উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন যে, আভ্যন্তরীণ খিলাফতে “দান” কৃপণের স্থান গ্রহণ করবে।

উপসংহার
কৃপণতা একজন ব্যক্তির জীবন, পরিবার ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কর্মকর্তাদের জন্য দানশীলতা ও সদয়তা অপরিহার্য, কারণ এটি আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দায়িত্বের মূল ভিত্তি। দানশীল ও সদয় নেতৃত্ব সমাজে নৈতিকতা, শান্তি ও বিকাশ নিশ্চিত করে। এটি মানুষকে আল্লাহর পথে আত্মসংযম ও নৈতিক উৎকর্ষ অর্জনের সুযোগ দেয়।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে দানশীল ও সদয় ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলুন এবং সমাজে নৈতিকতা ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার সাফল্য দান করুন। আমীন।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha